সোমবার, ২৫ জুলাই, ২০১৬

তুহিন দাস



গেল দিনের কাদায় ভাঙা সুর


অরুণ দা মারা গেলেন ২৬ মার্চ ২০১৬। প্রিয় অরুণ সেন। চট্টগ্রামের অরুণ সেন (কলকাতার অরুণ সেন নয়)। কবি অরুণ সেন। ১৬ বছর পূর্বে যখন কবিতার পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেছিলাম তখন যারা আমাকে নিয়মিত লেখা দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন তাদের মাঝে অরুণ দা'কে মনে করার যথেষ্ট কারণ নিজের কাছে আছে। ২০০৯ ও ২০১০ এর দিকে অনেকবার আড্ডা হয়েছে চেরাগীতে, তার বাসায়ও গেছি দুবার। কথা বলার মাঝে স্নেহটুকু খুঁজে নিতে বেগ পেতে হয়নি।

২০১৫ সালে বেশ কয়েক মাস চ্ট্টগ্রামে ছিলাম, দেখা হয়নি অরুণ সেনের সঙ্গে বা কারো সঙ্গে। তবে অরুণ দা'কে মনে পড়তো, মনে পড়তো পুরনো স্বজনদের কথা, কবিতার পরীক্ষিত যোদ্ধাদের কথা, কবিতার সঙ্গে যাদের আজন্ম আবাস। মনে পড়তো এ শহরেও তিনিও আছেন, ঘোরাফেরা করেন, এ শহরের হাওয়ায় তার নিশ্বাস মিশে আছে।  সে এক সময় ছিল চিঠিপত্রের দিনের। কত বন্ধুরা রঙবেরঙের খামে ও কাগজে চিঠি লিখে পাঠাতো। কবিতা নিয়ে, স্বপ্ন নিয়ে। অরুণ দা’ও লিখতেন দু’কলম, আর তার নতুন নতুন বই। ছন্দে লেখা, মমতা মাখানো, পরিচ্ছন্ন রুচির সেসব বই। আর কবিতা আসতো রঙিন খামে। দেখলেই মন ভালো হয়ে যেতো। অপ্রাপ্তি ভুলে নতুন করে পত্রিকার নতুন সংখ্যার প্রস্তুতি নেয়া যেত। এরকম একটি কবিতা পড়া যাক, এবার, কবিতাটি ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমার সম্পাদিত ‘আরণ্যক’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল—

ইয়ার্কি


হাঁটি হাঁটি পা রাখা পথ কূল সাঁতরাতে চায়
হোঁচট খেয়ে ক’বার পড়ে পথিকে সাঁতরায়

উঠি উঠি রোদ যেখানে ফুটন্ত চোখ তোপে
জলের কোপে ঠাঁই পড়েছে আর কতদূর মাপে

উল্কা লেগে ছাই হলে ঘুম চরকি নাচের মতন
ওপথে ওই চাঁদ ঝুঁকেছে এদিকটাতে পাতন

নিশানাটা ঝুলের সাথে লটকে দেখে নীচে
ঠোঁটের ফাঁকে জিভ বেরুনো রৌরব অতি কাছে

          বৃষ্টি এলো ঝমঝমিয়ে মাটিতে রোয় ছল
সাহস-পোড়া মই লেগেছে কে নেবে তার ফল

ফল কুড়ানি ঘুম পেয়েছে ঘুমের হাটে যাওয়া
কাজ সেরে নেয় শান্ত হয়ে স্বপ্নে অলীক নাওয়া

ওপথ তুমি এবার বল, নামটা জানি কি?
‘--আর কিছু না, ভালবাসা নামের ইয়ার্কি।‘

কেন জানি এ কবিতাটি আমার ভাল লেগে গিয়েছিল। জীবনের সহজ বোধের প্রকাশ বুঝি আমার ভাল লেগেছিল। কিন্তু তার নিন্দুকও কম ছিল না। তাদের মাঝে মাত্র দু’দিন হল লিখতে আসা সদ্য গোঁফওঠা ছেলেরাও ছিল, আর ছিল তাদের গুরুরা। তারা অরুণ দাকে নিয়ে নানারকম কথা চাউর করে বেড়াতো। তাদের কথা শুনে অরুণ দা সম্পর্কে ভীতি জন্মানোর কথা, কিন্তু মানুষটির সঙ্গে মিশলে অনেক প্রাণবন্ত একটা মানুষ মনে হতো। মানুষের সঙ্গ তিনি ভালোবাসতেন। চিঠি লিখতেন কম। কবিতা পাঠালে তার সঙ্গে কখনো কখনো থাকতো সংক্ষিপ্ততম পরিমিত চিরকুট:’তুহিন লেখা পাঠালাম। ভাল থেকো।‘ ইতি-অরুণ দা।

তিনি শুধু কবি নন, নিজেও একজন সম্পাদকও। ‘ঋতপত্র’ নামে একটি অনিয়মিত পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। যত্ন নিয়ে সারা বাংলাদেশের কবিতা ছাপতেন তিনি। উল্টেপাল্টে-পড়ে দেখতাম তার পত্রিকা, রুচির ছাপ ছিল সে পত্রিকায়। কথাটি অপ্রিয় হলেও সত্য, বেশভূষায় আধুনিক ছিলেন না বলে যারা তাকে চট্টগ্রামে এড়িয়ে চলতো তারা তার কবিতা ছাপার রুচি দিয়ে তাকে কখনো মেপে দেখেনি তারা, মেপে দেখেছিল বহিরাঙ্গ দিয়ে, তার অন্তরাঙ্গে যে এক রসময় আজীবন কবিতামোদী সংস্কৃতবান মানুষ ছিল তাকে তারা বুঝতে চায়নি, ভালবাসেনি। কিন্তু আমরা ভালবেসেছি অরুণ দা’কে। দূর থেকে। কবিকে কখনো কখনো দূর থেকে দেখতে হয়। তাহলে মুগ্ধতা অটুট থাকে। মুগ্ধতা ভেঙে দিয়ে কি লাভ! কিন্তু অরুণ সেন সম্পাদিত ‘ঋতপত্র’ পত্রিকায় কিন্তু কখনও আমার লেখা ছাপা হয়নি। তাতে কি? কখনো আমার লেখা চেয়েছিলেন বলে মনেও পড়ে না। চেয়েছিলেন কি? হতেও পারে। হলেও তাও একবার, কেমন ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়ে যেন। লেখা নেবার মতো তাগাদা সে ছিল না সে আহ্বানে, সে কারণে বোধহয় কখনোই ‘ঋতপত্র’ পত্রিকায় আমার লেখা ছাপা হয়নি। তবু অরুণ সেন আমাদের সময়ের প্রিয় সম্পাদকের মধ্যে একজন ছিলেন। তাকে সে স্থানটুকু দিতে আজ আর কোন কার্পণ্য নেই।

সেসব দুপুরবেলার কথা এই চৈত্রের খররোদে মনে পড়ে। মনে পড়ে তার একটি কথা, তুহিন জীবন কি আমাদের এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে, তার কথার প্রচ্ছন্নে ছিল আমাদের সমাজ, যাকে তিনি তার প্রজন্মে অবক্ষয়ে ডুবে যেতে দেখেছেন, আমাদের প্রজন্ম নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন, তার কবিতায়ও এসে পড়েছিল এ ছায়া, তাই কবিতা ও তার কবিতা পত্রিকাকে ঘিরে তিনি যে সময় ও সমাজসচেতন আন্দোলনের কবিতাযোদ্ধা হিসেবে সময়কে ধরতে চেয়েছিলেন, জানাতে চেয়েছিলেন লড়াই করো, কেননা মানুষ এখন বিপন্ন। যেমন তার একটি কবিতা আছে, নাম:’বোবা কথার ঘর’। সে কবিতায় তিনি একটি শিশুর বর্ণনা দিচ্ছেন এভাবে: শিশুটি সবে একটু আধটু হাঁটা শিখছে, তার কাছে সব কিছু নতুন। আলোবাতাস, দেয়াল, কাঠ, কংক্রীট সব। কিন্তু হঠাত করে কে জানি তার শৈশবটাকে চুরি করে নিয়ে গেল। সে এসে পড়ে থাকলো একমাত্র বই ছাড়া অথর্ব বিষয়গুলোর মাঝে। এ কবিতাটাও আমার এটি প্রিয় কবিতা। আচ্ছা, যেহেতু আমার প্রিয় কবিতা তাই না হয় এটা পড়া যাক—

বোবা কথার ঘর


শিশুটি সবে এক আধটু হাঁটা শিখছে, হাঁটা
আলো বাতাস সব অচেনা।
চেনার পথে হঠাত করে বই
দু’চোখ বেঁধে এক ঠেলাতে
ইচ্ছেগুলো বাধার মুখে বোকা
ভুলের বশে খোরাক হয়ে হাসি
শৈশবটা গিলতে কি যে খুশি
কেউ জানেনি, কৌশোরটা কখন দিল ফাঁসি
একদিন সে বেরিয়ে এসে দেখতে পেল
কিতাব ছাড়া, সব অজানা, অচেনারাই পাশে

জীবন থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা দূর
পেছন ফিরে শুধু দেখছে, গেল দিনের কাদায় ভাঙা সুর

এ কথাগুলো তো আমাদের সবার। সবকিছু রেডিমেড এখন। চেরাগী পাহাড়ে দাঁড়িয়ে রেডিটিতে চুমুক দিতে দিতে বলছিলেন-’সবকিছু এখন রেডিটি হয়ে যাচ্ছে, প্রস্তুতি নেই কোন। কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই। মানুষ হবার জন্যও এখন কোন প্রস্তুতি লাগে না।’সেই অরুণ দা'কে আমার দূর থেকে কয়েকটা বছরের জমানো ভালবাসা। না ফেরার দেশে চিরতরে ভাল থাকুন তিনি। কবিকে যখন আগুন পোড়ায় চমকে যায় আগুনের হাড়।



মতামত জানানোর জন্য ধন্যবাদ, কার্তুজ'এর সঙ্গেই থাকুন।